ঢাকা খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
ফিচার

তামাকমুক্ত দেশ গড়তে সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন

ওসমান গণি ১৮ জুন ২০২৫ ০৪:৩১ পি.এম

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদের বাংলাদেশেও প্রতি বছর ৩১ শে মে পালন করা হয়ে থাকে। এটি  হল একটি বার্ষিক বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠান, যা ৩১শে মে পালিত হয়, যা স্বাস্থ্যের উপর তামাক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তামাক সেবন কমাতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নিবেদিত। ২০২৫ সালের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় অর্জিত অগ্রগতির প্রতিফলন, বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলি স্বীকার করা এবং তামাকমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন  করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশটি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই লক্ষ্য পূরণে যেসব বড় বাধা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তামাক। ধূমপান ও অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের ভয়াবহ বিস্তার আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেমন চাপে ফেলছে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিকেও ক্ষতির মুখে ফেলছে। তামাকের করালগ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে এখনই প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ।
 
তামাক এমন একটি নীরব ঘাতক, যার ক্ষতিকর প্রভাব ধীরে ধীরে শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নেয়। একদিকে এটি মানসিকভাবে মানুষকে আসক্ত করে তোলে, অন্যদিকে শারীরিকভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তামাকজাত দ্রব্যের মধ্যে যেমন রয়েছে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল, খৈনি, তেমনি রয়েছে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-এর মতো আধুনিক বিপজ্জনক রূপ। প্রতিটি রূপেই এটি মানবদেহের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রায় এক লাখের কাছাকাছি। তামাকের ধোঁয়ায় থাকা ৭,০০০-এর বেশি রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে অন্তত ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ধূমপানের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, কিডনি সমস্যা, গর্ভকালীন জটিলতা— এমনকি অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ।
 
তামাক শুধু ব্যবহারকারীর জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং আশেপাশের নিরীহ মানুষকেও ক্ষতির মুখে ফেলে। একে বলে প্যাসিভ স্মোকিং। শিশুরা যখন পরিবারের সদস্যদের ধূমপান করতে দেখে, তখন তারাও প্ররোচিত হয় এবং ভবিষ্যতে তামাক ব্যবহারকারী হয়ে ওঠে। তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে দেশের স্বাস্থ্যখাতে বিশাল অঙ্কের ব্যয় হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগের কারণে চিকিৎসা ও কর্মক্ষমতা হ্রাসে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা দেশের জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশকে ব্যর্থ করে তোলে। অথচ তামাক কর বাবদ যা আয় হয়, তা এই ব্যয়ের তুলনায় নগণ্য।
 
তামাকের আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো— এটি দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নিম্ন আয়ের মানুষদের বড় একটি অংশ আয়-রোজগারের সিংহভাগই তামাক কিনে নষ্ট করে। একইসঙ্গে পরিবারের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান খাতে ব্যয় কমে আসে। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে যায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো— তরুণ ও কিশোরদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফ্যাশনের নামে, ৈৌবন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায়, মিউজিক ভিডিও কিংবা বিজ্ঞাপন দেখে তরুণরা তামাকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে পড়ছে।
 
সবমিলিয়ে বলা যায়, তামাক কেবল একটি ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়— এটি একটি সামাজিক ব্যাধি, একটি স্বাস্থ্য সংকট এবং একটি অর্থনৈতিক দুর্যোগ। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই সম্মিলিত প্রয়াস, কঠোর আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও সচেতনতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তবেই আমরা একটি তামাকমুক্ত, সুস্থ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, পরোক্ষভাবে তামাক ব্যবহার অন্যদের জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে। গণপরিবহন, অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও খোলামাঠে ধূমপানের ফলে আশেপাশের মানুষও ‘প্যাসিভ স্মোকার’ হয়ে পড়ছে। শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা জাতীয় বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে অকার্যকর করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাত দ্রব্যের চিকিৎসা ব্যয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বার্ষিক কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অন্যদিকে, তামাক খাতে যারা যুক্ত, তাদের জন্য বিকল্প জীবিকা গড়ার সুযোগ থাকলেও এটি এখনো বাস্তবায়নের পথে বাধাগ্রস্ত। ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যহানী, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক মন্দা  দুই দিক থেকেই তামাক আমাদের সমাজে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।
 
বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে “ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন” প্রণয়ন করে এবং ২০১৩ সালে সেটির সংশোধনী এনে আইনটিকে আরও শক্তিশালী করে। আইন অনুযায়ী, জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচার ও স্পন্সরশিপ নিষিদ্ধ। এছাড়াও, তামাক পণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার তামাকজাত দ্রব্যের কর কাঠামো উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে এখনও বেশকিছু ফাঁক-ফোকর রয়েছে, যেগুলো পণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো অপব্যবহার করছে। বিশেষ করে তরুণ ও কিশোরদের জন্য কমদামি সিগারেট সহজলভ্য হওয়ায় তারা ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
 
আমাদের সমাজে তামাক সেবন অনেকসময় বাহাদুরি বা সামাজিকতার অংশ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনেক পরিবারেই বাবা-মা নিজেরা ধূমপান করেন এবং শিশুরাও তা দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে তামাকের ভয়াবহতা চলে যাচ্ছে।
এছাড়া, কিছু ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে জর্দা, গুল ইত্যাদি ব্যবহার এখনো একটি প্রচলিত রীতি হয়ে আছে। এই ধরণের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বদলাতে হলে আমাদের প্রয়োজন প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব, সচেতন পরিবার, এবং কার্যকর গণমাধ্যম।
তামাকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাঠ্যবইয়ে তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা, বিশেষ ক্লাসে আলোচনা, পোস্টার ক্যাম্পেইন, ডিবেট প্রতিযোগিতা, নাটিকা পরিবেশন ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। শিক্ষকরা যদি নিজেরাই ধূমপান পরিহার করেন, তবে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্ত বার্তা হয়ে দাঁড়াবে। একটি তামাকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য শুধু সরকারের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। নাগরিক সমাজ, এনজিও, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তামাকবিরোধী প্রচারণা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে যেমন 'ধূমপান নিষিদ্ধ এলাকা' গড়ে তোলা যায়, তেমনি জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা বাড়ানো যেতে পারে। পরিবার থেকেই যদি তামাকবিরোধী শিক্ষা শুরু হয়, তাহলে একটি স্থায়ী ও কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব।
 
অনেক কৃষক এখনও তামাক চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে ফলমূল, সবজি, তেলজাতীয় ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এনজিও ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে এসে লাভজনক ফসল চাষের দিকনির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। একইভাবে, তামাক শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদেরও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে যাতে তারা জীবিকার জন্য আর তামাকের ওপর নির্ভর না করে। একটি সুস্থ, সবল, সচেতন ও কর্মক্ষম জাতি গড়তে হলে তামাকের মরণফাঁদ থেকে জাতিকে রক্ষা করতেই হবে। শুধু আইন দিয়ে নয়, সামাজিকভাবে তামাককে ‘অবাঞ্ছিত’ করে তুলতে হবে। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষা, জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হ্রাস করতে হলে এখনই সময়— আমরা সকলে মিলে তামাকবিরোধী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তামাক নয়, জীবন হোক অগ্রাধিকার। একটি তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার এই যাত্রায় আমরা যেন কেউ পেছনে না থাকি। আসুন, সবাই মিলে অঙ্গীকার করি— “তামাক নয়, সুস্থ জীবনের পথে হাঁটব আমরা।

আরও খবর

news image

আম ব্যবসায় সাফল্য: বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন সোহাগের 

news image

তামাকমুক্ত দেশ গড়তে সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন

news image

সৌখিন কৃষি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানবিক সেবা কাজে কুসুমপুর গ্রামবাসীর ভালোবাসায় শিক্ত ভেষজ বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ টিপু সুলতান পিএইচডি 

news image

প্রযুক্তিগত সুফল কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে

news image

পথে প্রান্তরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে জারুল ফুল

news image

হাওরে কান্দা কাটায় গোখাদ্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস

news image

দক্ষিনাঞ্চল থেকে হাড়িয়ে যাচ্ছে ফুটপাতে চুলকাটার ঐতিহ্য

news image

জোসেফ মাহতাবের এক বহুমুখী সমাজ সংস্কারকের অন্যতম গল্প

news image

শেরপুরের মাটি সূর্যমুখী চাষে বেশ উপযোগী

news image

আমতলীতে আমের মুকুলের মৌমৌ গন্ধে দল বেঁধে মধু আহরনে ছুটছে মৌমাছি

news image

আমতলী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বেত ও বেতফল

news image

ভবেন্দ্র মোহন সাহা থেকে ভবা পাগলা হয়ে উঠার গল্প

news image

দক্ষিনাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গানের পাখি দোয়েল